গণহত্যা ও নির্যাতন ১৯৭১ সাল (২৫শে মার্চ মধ্যরাত)

গণহত্যা ও নির্যাতন


দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। আমরা এর আগে জেনেছি, ২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। রাতেই তারা সেনানিবাস, ইপিআর দপ্তর, পুলিশলাইন্স ও আনসার ব্যারাকে হামলা চালিয়ে বাঙালি সদস্যদের হত্যা ও বন্দি করতে শুরু করে। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও তাঁতিবাজারসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালায় ও বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় ।



পাকিস্তানি বাহিনী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দেখামাত্র হত্যার নীতি গ্রহণ করে। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ছিল তাদের নির্বিচার হত্যার প্রধান শিকার। তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট, পাড়া ও গ্রাম লুট করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিশেষ টার্গেট। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ও শেষ পর্যায়ে এভাবে দেশকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা থেকে তারা বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপকভাবে হত্যা করে।


দেশের অভ্যন্তরে মানুষ ছিল অবরুদ্ধ, অনেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের ভয়ে পুরো নয় মাস দেশের ভিতরে আত্মগোপন করে জীবন কাটিয়েছে। আর প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। শরণার্থী শিবিরে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, অপুষ্টিতে ও রোগে ভুগে বহু শিশু প্রাণ হারায়। বৃদ্ধ ও নারীদের জীবনেও নেমে আসে চরম নিপীড়ন। একইভাবে দেশের ভিতরে অবরুদ্ধ মানুষও পাকস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের গণহত্যার শিকার হয়। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে ২০মে ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা ঘটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা। পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য এদেশের মুসলিমলীগ ও জামায়াতে ইসলামির নেতারা রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী গঠন করে। এই সকল বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানসহ অনেকে। তারা বাংলাদেশ, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এদের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংগঠিত হয় নিরাপরাধ লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড। নারী নির্যাতনের মতো ঘৃণিত কাজও রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী সরাসরি জড়িত ছিল।



৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যৌথবাহিনীর আক্রমণের ফলে পাকিস্তানের পরাজয় যখন নিশ্চিত তখন তারা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার নীল নকশা তৈরি করে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সঙ্গীতজ্ঞদের ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে। এই নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, সাহিত্যিক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ও কথাশিল্পী আনোয়ার পাশা, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সাংবাদিক নিজামউদ্দিন ও সিরাজউদ্দিন হোসেন, লেখিকা সেলিনা পারভীন ও মেহেরুন্নেসা এবং সাহিত্যিক শহীদ সাবের, ডা. ফজলে রাব্বী ও ডা. আলিম চৌধুরী, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, নূতন চন্দ্র সিংহ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মশিউর রহমান, সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদের মতো বরেণ্য ব্যক্তিগণ। জাতির এ সূর্য সন্তানদের অধিকাংশই ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাই তাঁদের স্মরণে প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বর আমরা শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে থাকি । বিজয় অর্জনের পরে এসব সূর্য সন্তানদের লাশ রায়ের বাজারসহ বিভিন্ন বদ্ধভূমিতে পাওয়া যায়। এই অপরাধের দায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর উপর বর্তায়।


এই পরিকল্পিত গণহত্যা চালাতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা এদেশে অনেক বধ্যভূমি তৈরি করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি বড় বধ্যভূমি হলো ঢাকার রায়েরবাজার, চট্টগ্রামের পাহাড়তলি, খুলনার খালিশপুর, সিলেটের শমসেরনগর ইত্যাদি। সারাদেশে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমায় নির্জন নদীতীর ও চা বাগানেও অসংখ্য বধ্যভূমি গড়ে তুলেছিল ঘাতকরা।



এই গণহত্যা চলেছে সারাদেশে পুরো নয় মাস জুড়ে। যদিও খুবই নিষ্ঠুর ও লোমহর্ষক তবুও বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের নির্যাতনের ধরন সম্পর্কে আমাদের কিছুটা হলেও জানা দরকার। পাকিস্তানি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নির্যাতন করে পরে তারা আটককৃতদের হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করে নদী, জলাশয় ও গর্তে ফেলে রাখতো। এছাড়া একটি একটি করে অঙ্গচ্ছেদ করে গুলি করে হত্যা করতো। চোখ উপড়ে ফেলা, মাথায় আঘাত করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা, মুখ থেঁতলে দেওয়া, বেয়নেট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হৃদপিণ্ড উপড়ে ফেলা, আঙ্গুলে সূঁচ ফুটানো, নখ উপড়ে ফেলা, শরীরের চামড়া কেটে লবণ ও মরিচ দেওয়া ছিল অত্যাচারের নিষ্ঠুর ধরন। বন্দীশালা ও বধ্যভূমি থেকে বেঁচে আসা অনেকের কাছ থেকে পাওয়া বিবরণ আরও ভয়াবহ যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

Shahariar Islam

Hi, I am Shahariar. I try to write something new that no one has written before. A student that likes to learn something new all the time.

*

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post